ভূমিকা
বর্তমান যুগে মানুষ বিভিন্ন অসুখ-বিসুখ, মানসিক চাপ, মাথাব্যথা, গ্যাস্ট্রিক, অনিদ্রা ইত্যাদি সমস্যায় ভুগছে। অনেকেই ওষুধ খেয়ে সাময়িক সমাধান পান, কিন্তু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে দীর্ঘমেয়াদে সমস্যা বেড়ে যায়। এই অবস্থায় অ্যাকুপ্রেসার (Acupressure) একটি প্রাকৃতিক, সহজ এবং কার্যকর উপায় হিসেবে সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
অ্যাকুপ্রেসার হল এক ধরনের প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি, যেখানে শরীরের নির্দিষ্ট পয়েন্টে চাপ প্রয়োগ করে রোগ নিরাময় করা হয়। এটি চীনা চিকিৎসা পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং প্রায় ৫০০০ বছর ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে।
অ্যাকুপ্রেসার কী?
অ্যাকুপ্রেসার শব্দটি এসেছে ইংরেজি “Acupressure” থেকে।
- Acus = সূঁচ (তবেএখানেসূঁচব্যবহারহয়না, কেবলচাপদেওয়াহয়)
- Pressure = চাপদেওয়া
সহজভাবে বললে, শরীরের নির্দিষ্ট পয়েন্টে আঙুল বা বিশেষ যন্ত্র দিয়ে চাপ প্রয়োগ করে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করা, ব্যথা কমানো এবং শরীরের প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ক্ষমতা জাগ্রত করাই অ্যাকুপ্রেসারের মূল লক্ষ্য।
অ্যাকুপ্রেসারের ইতিহাস
· প্রায় ৫০০০ বছর আগে চীনে এর সূচনা হয়।
· ভারতীয় প্রাচীন আয়ুর্বেদ চিকিৎসার সাথেও এর মিল পাওয়া যায়।
· বর্তমানে ইউরোপ, আমেরিকা, জাপানসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এটি বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
অ্যাকুপ্রেসারের কার্যপদ্ধতি
মানবদেহে প্রায় ৩৫০+ অ্যাকুপ্রেসার পয়েন্ট রয়েছে, যা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের সাথে যুক্ত।
· নির্দিষ্ট পয়েন্টে চাপ দিলে নার্ভ ও এনার্জি চ্যানেল সক্রিয় হয়।
· রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যায়।
· হরমোনের ভারসাম্য বজায় থাকে।
· শরীর থেকে টক্সিন বের হয়ে যায়।
এভাবে শরীরের প্রাকৃতিক নিরাময় ক্ষমতা জেগে ওঠে।
অ্যাকুপ্রেসারের উপকারিতা
1.
মাথাব্যথা ও মাইগ্রেন দূরীকরণ
মাথার নির্দিষ্ট পয়েন্টে চাপ দিলে তাৎক্ষণিকভাবে মাথাব্যথা কমে যায়।
2.
অনিদ্রা ও মানসিক চাপ কমানো
কিছু নির্দিষ্ট প্রেসার পয়েন্ট ঘুম আনতে ও মস্তিষ্ককে শান্ত রাখতে সহায়তা করে।
3.
গ্যাস্ট্রিক ও হজম সমস্যা সমাধান
পেটের পয়েন্টে চাপ প্রয়োগ করলে হজমশক্তি ভালো হয়।
4.
মাসিকের ব্যথা উপশম
মেয়েদের মাসিককালে ব্যথা কমাতে এটি কার্যকর।
5.
ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য
কিছু বিশেষ পয়েন্টে চাপ দিলে অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা কমে যায়।
6. পিঠ ও কোমরের ব্যথা দূরীকরণ
7. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি
অ্যাকুপ্রেসার করার পদ্ধতি
👉 অ্যাকুপ্রেসার করতে কোনও ওষুধ বা ইনজেকশন লাগে না।
👉 এটি করা যায় ঘরে বসে বা প্রশিক্ষিত বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়ে।
ধাপসমূহ:
1. শরীরের নির্দিষ্ট প্রেসার পয়েন্ট খুঁজে বের করতে হবে।
2. আঙুলের ডগা, বুড়ো আঙুল বা বিশেষ অ্যাকুপ্রেসার স্টিক ব্যবহার করে ২–৩ মিনিট চাপ দিতে হবে।
3. প্রতিদিন ১০–১৫ মিনিট অ্যাকুপ্রেসার করলে ধীরে ধীরে ফলাফল দেখা যায়।
যেসব রোগে অ্যাকুপ্রেসার কাজে লাগে
· মাইগ্রেন ও মাথাব্যথা
· গ্যাস্ট্রিক, কোষ্ঠকাঠিন্য
· হরমোনজনিত সমস্যা
· অনিদ্রা
· মানসিক চাপ ও উদ্বেগ
· সর্দি-কাশি
· হাড় ও জয়েন্টের ব্যথা
· ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
অ্যাকুপ্রেসারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট
1. হেগু পয়েন্ট (LI-4): হাতের বুড়ো আঙুল ও তর্জনীর মাঝখানে – মাথাব্যথা, দাঁতের ব্যথা কমায়।
2. ইন-তাং পয়েন্ট: দুই ভ্রুর মাঝখানে – অনিদ্রা ও উদ্বেগ কমায়।
3. জু-সান-লি পয়েন্ট (ST-36): হাঁটুর নিচে – হজম শক্তি বৃদ্ধি করে।
4. তাই-চুং পয়েন্ট (LV-3): পায়ের বুড়ো আঙুল ও দ্বিতীয় আঙুলের মাঝখানে – স্ট্রেস কমায়।
অ্যাকুপ্রেসারের সীমাবদ্ধতা
যদিও অ্যাকুপ্রেসার খুবই উপকারী, তবে এর কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে:
· এটি তাৎক্ষণিক অলৌকিক চিকিৎসা নয়; নিয়মিত করতে হয়।
· গুরুতর অসুখ (ক্যান্সার, হার্ট অ্যাটাক ইত্যাদি) নিরাময়ে এটি একমাত্র সমাধান নয়।
· ভুল পয়েন্টে চাপ দিলে সাময়িক ব্যথা বাড়তে পারে।
অ্যাকুপ্রেসার বনাম আকুপাংচার
অনেকে অ্যাকুপ্রেসার আর আকুপাংচারকে এক মনে করেন, কিন্তু এ দুটো আলাদা:
· অ্যাকুপ্রেসার: কেবল আঙুল বা চাপ প্রয়োগ করা হয়।
· আকুপাংচার: সূঁচ ব্যবহার করে শরীরের নির্দিষ্ট স্থানে প্রবেশ করানো হয়।
উপসংহার
অ্যাকুপ্রেসার হলো একটি সহজ, সাশ্রয়ী, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতি, যা নিয়মিত করলে শরীর সুস্থ ও মানসিকভাবে প্রশান্তি পাওয়া যায়। তবে গুরুতর রোগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
👉 তাই প্রতিদিন কিছু সময় বের করে অ্যাকুপ্রেসার করুন, সুস্থ থাকুন, হাসিখুশি থাকুন।